Friday, May 22, 2015

এবার থুড়ি গতবার পুজোয়







 
(শুরু করেছিলাম “এবার পুজো” দিয়ে কিন্তু  পোস্ট করছি “সেবার পুজো” বলে…। আলসেমি আর কি????)
 
কিছু করিনি বললে ভুল হবে। করেছি কিন্তু মন ছিল না। টেনশন ও ছিল কম না। মাকে নিয়ে পুজো প্যান্ডেলে যাওয়া ...।মার বয়স বিরাষী বছর তাঁর উপর রিসেন্টলি একটা বদ-খদ রোগের স্বীকার হয়েছেন। পুজোর কিছু দিন আগে নিউ রাজিন্দর নগর থেকে হুইল-চেয়ার কিনে আনা হ’ল যাতে দরকার হ’লে মাকে তাতে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। তবে ভগবানের দয়ায় হুইল-চেয়ারটি একদিন (অষ্টমীর সন্ধ্যাবেলা) ছাড়া আর কোনো দিন ব্যবহার করতে হয়নি। মাকে শুধু এক হাতে লাঠি আর আরেক হাতে শিবার (আমার বোনপোর) কাঁধে ভর দিয়ে প্যান্ডেলে  ঢুকতে দেখে কী যে আনন্দ হয়েছিল বলার নয়। ভাবিনি যে মা আগের মতন নিজের পায়ে হেঁটে গাড়ী থেকে মায়ের পুজো মন্ডপ অবধি আসতে পারবেন।


সবই মায়ের দয়া...


মাকে নিয়ে আশ্বস্ত হলাম বটে কিন্তু প্যান্ডেলের অবস্থা দেখে যাইপরনাস্তি বিচলিত বোধ করলাম। দশ বছর আগে পুজো প্যান্ডেলে ছিল রমরমা অবস্থা   এখন লোক হাতে গোনা যায়। মাসী-কাকীদের ঠাকুরের বেদীতে পুরোহিত মশাইকে পুজোতে সাহায্য করতে দেখা গেল। আর দেখা গেল রিটায়ার্ড জ্যাঠা–কাকাদের পুজোর অন্য সব ব্যাবস্থা সামলাতে। কিন্তু বাচ্চা–পার্টি যে লোপাট। নেই সেই কিশোর-কিশোরীর দল যারা প্যান্ডেল রাঙিয়ে আড্ডা জমাতো। আজকালকার দিনে এম এন সির কাজে ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব – পুজো যায় যাক। আবার পুজো কে দেখে? সন্ধ্যার সময় আরতির সঙ্গে কোমর দুলিয়ে হিন্দি –ফিল্মের স্টাইলে দু-তিনবার নাচলেই তো হল।


তাই হ’ল...


ষষ্ঠির দিন কালি বাড়ী...


অফিস থেকে ফেরার রাস্তায় প’ড়ে। নেবে পড়লাম। আমার বাহন চালক এসব ব্যাপারে ভীষণ উৎসুক ও উৎসাহী । সেও আমার সঙ্গে নেমে মায়ের মূরতি দেখে তারীফ না করে পারল না ।   


সৌভাগ্যক্রমে আমরা  পৌঁছনোর  সাথে-সাথে মন্দিরে আরতি শুরু হল। আর তার সঙ্গে আরম্ভ হল পাঁচ জোড়া ঢাকীর ঢাক বাজীয়ে তালে তাল দিয়ে নৄ্ত্য। এই মনোরম দৄশ্যের ছবি তুলতে ভুলিনি...












সপ্তমির দিন অফিস...


এবার পুজোয় ছুটি নিইনি। মার অসুস্থতার জন্য আগেই অনেক নিয়ে ফেলেছি। অবশ্য অফিস ফেরত প্ল্যান হল সোজা নিবেদিতা কলোনির (পশ্চিম বিহার) পুজারতি দেখার। দিদি, জামাই বাবু আর শিবা মাকে নিয়ে এল বাড়ী থেকে। কিন্তু এ কি? প্যান্ডেল যে প্রায় ফাঁকা। আগে পুজোয় প্যান্ডেলেই প্রায় সারা দিন কাটত। এখন সেই কমিউনিটি গ্যাদারিং এর মাহাত্য কমে গেছে। আমার এক বরিষ্ঠ সহকর্মী গত বছর তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, “পুজোয় এখন আর কে ছুটি নেয়? যা দেখার সব তো রাত্রে। দিনে অফিস করুন না।”


তবে সপ্তমির রাতে মাকে হেঁটে প্যান্ডেলে ঢুকতে দেখে মন আনন্দে ভরে গেল। ভাবিনি মাকে আবার সুস্থ অবস্থায় চলে ফিরে বেড়াতে দেখতে পাব। এবার পুজোয় এটাই সব চেয়ে বড় পাওয়া।


অবশ্যি পুজোর আমেজ আর আগের মতন নেই। গ্লোবলাইজেশনের যুগে মানুষ যেমন চিন্তা ধারার সীমিত গন্ডি অতিক্রম করে এক বিশ্ব ব্যাপক পরিধির মধ্যে নিজেকে দেখতে শিখেছে তেমনি আবার নিজের প্রান্তের সাংসকৄতিক বৈশিষ্টগুলিকে, ভুলতে বসেছে বললে ঠীক বলা হবে না, বরং বলব হয় এড়িয়ে চলতে শিখে গেছে নয় তার সঠিক মুল্যাংকন করতে অক্ষম হয়েছে। ব্যাপকতা মানব জাতিকে উদারচেতা হতে সাহায্য করে। তার বিচার ধারা ও দৃষ্টিকোণকে আরো বড় পরিমাপ ও পরিধি দেয়। কিন্তু তার মানে কি এই যে আমরা নিজেদের প্রান্তিক বৈচিত্র্য ও  বিশিষ্টতাগুলিকে বিসর্জন দেব? আমাদের সংস্কৃতি আমাদের গড়ে ওঠা ও বড় হওয়ার বিরাট মহত্ত্বপূর্ণ এক  অঙ্গ সেটা ভুলে গেলে বা সেটাকে বাদ দিলে কী করে চলবে? আরেকটা কথা যেটা প্রায়শই আমরা অগ্রাহ্য করে যাই সেটা হল আমাদের উত্তরসূরির প্রতি আমাদের দায় দায়িত্ত্ব। তাদের জন্য আমরা কী রেখে গেলাম?  আমার এ যুগের বন্ধু বান্ধবরা সময়াভাব, সামাজিক ও আর্থনৈতিক পরিবর্তন ও তারই সঙ্গে নিজস্ব রুচির বিবর্তনের দোহাই দেন। আমি সম্পূর্ণভাবে তাঁদের সঙ্গে এক মত হতে পারছি না।


মানলাম সময় পালটে গেছে এবং তার সঙ্গে অর্থোপার্জনের জটিলতা, জীবন নির্বাহের দায়বদ্ধতা এবং নানান প্রেশার, স্ট্রেস ইত্যাদি কিন্তু তাই বলে আমাদের প্রদেশের এত বড় একটা ঐতিহ্য এমন ভাবে নষ্ট হয়ে যাবে? ভাবতেও খারাপ লাগে।


অষ্টমীর দিন পুষ্পাঞ্জলী


মাস্ট। এবার ও  বাদ পড়ল না। তবে মা কে একটু বিষন্ন লাগল। ভক্তের দলের  এ্যটেন্ডেন্স যে এত কম হবে মা বোধহয় এতোটা আশা করেন নি। আমরা কী তাহলে ব্যাপক নাস্তিকতার দিকে অগ্রসর হচ্ছি? এটাই কী বস্তুবাদের চরম মাশুল? আবার প্রশ্ন ওঠে মনে – মূর্তি পুজা বা রিচুয়ালিজম না মানাই কী নাস্তিকতার লক্ষণ? আস্তিকতার একটা বৄহত্তর পরিভাষা কে অগ্রাহ্য করাটা ও সঙ্কীর্ণমনতা নয় কী?


তবে সন্ধ্যারতির সময় আবার ফিরে পেলাম সাবেকী রমরমা ... ধুনুচি নৄত্য, হৈ-হট্টগোল, আমোদ, হাঁসি-তামাশা আর সদল বলে আরতি দেখার ধুম!!! যাক এখন ও


আশা আছে...।


নবমী ও দশমীর  দিন বাড়ীতেই কাটল


পাঠকেরা বলবেন, অ্যাঁ! একি হল?” এতো সমীক্ষা, পর্যালোচনা ও নিন্দেবাদের পরে এই? হ্যাঁ, তাই। অনেক ঘুরে শেষে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাই নবমী ও দশমী দুইই বাদ পড়ল মাতৄ-দর্শণ। হয়তো আমারই মতন গোটা চাকুরীজীবীর দল ২৪x৭ জীবন নির্বাহ ও অর্থোপার্জনের তাগীদে ছুটে-ছুটে এতোই শ্রান্ত যে সামাজিক মেলামেশার দায়দায়িত্বর চেয়ে ছুটির দিনে গা এলিয়ে ঘরে পড়ে থাকাকেই প্রাধাণ্য দেয় আর মাকে মনে-মনে স্মরণ করে বলে, “ পাপ নিও না, মা। কর্তার ইচ্ছায়ই কর্ম। এও বুঝি তোমারই ইচ্ছা”।